গর্ভাবস্থায় রোজ কত ক্যালোরি দরকার? সুস্থ মা ও শিশুর জন্য সঠিক পুষ্টির গাইড।
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক বিশেষ সময়। এই সময় মায়ের খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টির উপর নির্ভর করে মা ও গর্ভের শিশুর সুস্থ বিকাশ। গর্ভাবস্থায় ক্যালোরির চাহিদা সাধারণ সময়ের চেয়ে কিছুটা বেড়ে যায়। তবে এই বৃদ্ধি কতটুকু হওয়া উচিত এবং কোন ধরনের খাবার থেকে এই ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত, তা নিয়ে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। আজকের ব্লগে আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
গর্ভাবস্থায় ক্যালোরির চাহিদা কেন বাড়ে?
গর্ভধারণের পর মায়ের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি, জরায়ুর আকার বৃদ্ধি, প্লাসেন্টার গঠন, অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং মায়ের শরীরের অতিরিক্ত রক্ত উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন হয়। এছাড়া, স্তন্যপান করানোর জন্য শরীরকে প্রস্তুত করতেও অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়।
প্রথম ট্রাইমেস্টার (১-১২ সপ্তাহ):
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসকে বলা হয় প্রথম ট্রাইমেস্টার। এই সময় শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হতে শুরু করে। প্রথম ট্রাইমেস্টারে অতিরিক্ত ক্যালোরির চাহিদা তেমন একটা বাড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, একজন সুস্থ গর্ভবতী নারীর প্রথম ট্রাইমেস্টারে দৈনিক অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন হয় না। তবে, কিছু ক্ষেত্রে সামান্য বৃদ্ধির প্রয়োজন হতে পারে, যা সাধারণত খাবারের পরিমাণ সামান্য বাড়িয়ে পূরণ করা সম্ভব। এই সময় সুস্থ, সুষম খাবার গ্রহণ করা জরুরি।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার (১৩-২৬ সপ্তাহ):
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার থেকে শিশুর দ্রুত বৃদ্ধি শুরু হয়। এই সময় মায়ের শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরির চাহিদা বাড়তে থাকে। সাধারণত, দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে একজন গর্ভবতী নারীকে দৈনিক প্রায় ৩৪০ ক্যালোরি অতিরিক্ত গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই অতিরিক্ত ক্যালোরি কোথা থেকে আসছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাঙ্ক ফুড বা চিনিযুক্ত পানীয় থেকে এই ক্যালোরি গ্রহণ করলে তা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বরং, পুষ্টিকর খাবার যেমন- ফল, সবজি, শস্য, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার থেকে এই ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার (২৭-৪০ সপ্তাহ):
গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস, অর্থাৎ তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে শিশুর বৃদ্ধি আরও দ্রুত হয়। এই সময় মায়ের অতিরিক্ত ক্যালোরির চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে একজন গর্ভবতী নারীকে দৈনিক প্রায় ৪৫০ ক্যালোরি অতিরিক্ত গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই অতিরিক্ত ক্যালোরি সঠিক উৎস থেকে গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার এই সময় মা ও শিশুর জন্য অপরিহার্য।
সঠিক ক্যালোরি গ্রহণের উৎস:
শুধুমাত্র ক্যালোরির পরিমাণ বাড়ালেই হবে না, কোন ধরনের খাবার থেকে এই ক্যালোরি আসছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত খাবারগুলো থেকে ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত:
- প্রোটিন: ডিম, মাছ, মাংস (চর্বিহীন), ডাল, শিম, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য।
- কার্বোহাইড্রেট: পূর্ণ শস্যের রুটি, ব্রাউন রাইস, ওটস, আলু।
- স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ, অলিভ অয়েল।
- ভিটামিন ও খনিজ: ফল ও সবজি (বিশেষ করে গাঢ় সবুজ শাকসবজি), ভিটামিন ডি, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- ব্যক্তিগত চাহিদা: ক্যালোরির চাহিদা প্রতিটি নারীর জন্য ভিন্ন হতে পারে। মায়ের উচ্চতা, ওজন, শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা এবং গর্ভাবস্থার আগের ওজন এই চাহিদা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ: গর্ভাবস্থায় সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা এবং ক্যালোরির চাহিদা সম্পর্কে একজন পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
- হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের কার্যকারিতা বজায় রাখতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
- কম ক্যালোরির উৎস এড়িয়ে চলুন: ফাস্ট ফুড, চিনিযুক্ত পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এগুলোতে পুষ্টির পরিমাণ কম থাকলেও ক্যালোরি অনেক বেশি থাকে।
গর্ভাবস্থায় সঠিক ক্যালোরি গ্রহণ এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া মা ও শিশুর সুস্থ জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে। সচেতনভাবে খাদ্য নির্বাচন করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলে এই বিশেষ সময়টিকে আরও আনন্দময় ও স্বাস্থ্যকর করে তোলা সম্ভব।